আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভুট্টো পরিবার পাকিস্তানের বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবার। সিন্ধু অঞ্চলে তিনশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিবারটির বাস। ভুট্টোরা পাকিস্তানের রাজনীতি ও সরকারে বড় ভূমিকা রেখেছেন। অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপল’স পার্টির (পিপিপি) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর নেতৃত্ব এই পরিবারের হাতেই। গত মাসের জাতীয় নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যে জোট সরকার গঠিত হলো, তার অন্যতম প্রধান অংশীদার এই পিপিপি।
ভুট্টো পরিবারের পুরুষরা যেমন দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন পরিবারটির নারীরাও। এখানে ভুট্টো পরিবারের কয়েকজন প্রভাবশালী নারীর পরিচয় ও তাদের কাজ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
আসিফা ভুট্টো জারদারি
পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর মেয়ে আসিফা ভুট্টো জারদারি। তাকে পাকিস্তানের ফার্স্টলেডি হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জারদারি। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) তথ্য সচিব ফয়সাল করিম কুন্দির বরাতে সোমবার (১১ মার্চ) এ খবর জানায় পাকিস্তানি গণমাধ্যম জিও নিউজ।
সাধারণত প্রেসিডেন্টের স্ত্রীই ফার্স্টলেডি হন। কিন্তু ২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর আর বিয়ে করেননি জারদারি। আর তাই মেয়ে আসিফাকেই ফার্স্টলেডি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। আসিফ আলি জারদারি ও বেনজির ভুট্টো দম্পতির তিন সন্তান। এক ছেলে ও দুই মেয়ে। সবার বড় ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। এরপর মেয়ে বখতাওয়ার ভুট্টো জারদারি। সবার ছোট মেয়ে আসিফা ভুট্টো জারদারি।
আসিফার জন্ম ১৯৯৩ সালে। ২০০৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে নিহত হন মা বেনজির। তখন আসিফার বয়স ১৪। পাকিস্তানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য অক্সফোর্ড ব্রুকস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন আসিফা। এরপর ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেন। ২০২০ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) একটি সমাবেশে অংশ নেয়ার মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় আসিফার। রাজনীতির পাশাপাশি পোলিও নির্মূলেও কাজ করেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ও ফেসবুকে রয়েছে তার সরব উপস্থিতি। প্রায়ই তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক মন্তব্য করতে দেখা যায়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে আসিফাকে ভাই বিলাওয়াল ভুট্টোর পক্ষে বিভিন্ন সমাবেশ ও নির্বাচনী প্রচারণায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।
গত রোববার পাকিস্তানের ১৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো–চেয়ারম্যান আসিফ আলি জারদারি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলেন তিনি। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন আসিফ আলি জারদারি। সেই সময় ফার্স্টলেডির পদ খালিই ছিল। তবে এবার পদটি আর খালি থাকছে না।
বেনজির ভুট্টো
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে। মুসলিম বিশ্বের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের পুরুষশাসিত রাজনীতিতে নিজেকে সফল নারী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
বেনজির ভুট্টোর জন্ম ১৯৫৩ সালে। হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি। তার বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৭ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলে বেনজির ভুট্টো দেশে ফিরে আসেন। প্রতিপক্ষের এক নেতাকে খুনের অভিযোগে ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে বেনজির ভুট্টো মাত্র ২৬ বছর বয়সে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বেনজির ভুট্টো তার বাবাকে উৎখাতকারী সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হন। তিনি মূলত ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। এরপর ১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডনে চলে যান। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনমত গঠন করেন।
১৯৮৮ সালের আগস্টে জেনারেল জিয়াউল হক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এর তিন মাস পর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি জয়ী হলে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেনজির। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২০ মাস পর সংবিধান লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে প্রেসিডেন্ট তাকে বরখাস্ত করেন। ১৯৯৩ সালের নির্বাচনে বেনজির জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্রমবর্ধমান সমস্যার মধ্যে জনসাধারণের আস্থা হারালে ১৯৯৬ সালে তাকে ফের বরখাস্ত করা হয়।
১৯৯৭ সালের নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ক্ষমতায় আসে। বেনজির ও তার স্বামী আসিফ আলী জারদারি সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও বিভিন্ন আর্থিক অসদাচরণের অভিযোগের মুখোমুখি হন। ১৯৯৯ সালে বেনজির নির্বাসনে থাকার সময় তাকে ও তার স্বামীকে যথাক্রমে তিন ও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে উচ্চ আদালত এই রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে ঘোষণা দেন।
প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সাধারণ ক্ষমা অনুমোদন করলে বেনজির ভুট্টো দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আট বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে। দেশে ফেরার দুই মাস পরই ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হন। মায়েরমৃত্যুর পরমাত্র ১৯ বছর বয়সে পিপিপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো।
ফাতিমা ভুট্টো
ফাতিমা ভুট্টো। বর্তমানে ভুট্টো পরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। একাধিক বই লিখেছেন। স্বনামধন্য পত্রিকায় কলামও লেখেন তিনি।
১৯৮২ সালে আফগান রাজধানী কাবুলে জন্ম। বাবা মর্তুজা ভুট্টো। মা আফগান বংশোদ্ভূত ফৌজিয়া ফসিহুদ্দিন ভুট্টো। ফাতিমার বেড়ে ওঠা সিরিয়া ও করাচীতে। তার বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা-মার বিচ্ছেদ হয়। বাবা মর্তুজা ভুট্টো তাকে নিয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে গিনওয়া নামে লেবানিজ বংশোদ্ভূত এক নারীকে বিয়ে করেন। ফাতিমা গিনওয়াকে তার আসল মা বলে মনে করেন।
ফাতিমা করাচী আমেরিকান স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধীন বার্নার্ড কলেজ থেকে অনার্স ডিগ্রি নেন। এরপর ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যের এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। দাদা জুলফিকার আলী ভুট্টো ও বাবা মর্তুজা ভুট্টোর মতো রাজনীতিতে যাননি ফাতিমা। বরং উচ্চশিক্ষার পর লেখালেখিতে মনযোগী হন। তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। লেখক হিসেবে তিনি বেশ সফল।
১৯৯৭ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘হুইসপার্স অব দি ডেজার্ট। তবে বর্তমানে নন-ফিকশনই বেশি লেখেন। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে সংস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ড: অ্যা ডটার্স মেমোয়ার, দ্য শ্যাডো অব দ্য ক্রিসেন্ট মুন, দ্য রানওয়েজ, নিউ কিংস অব দ্য ওয়ার্ল্ড: দ্য রাইজ অ্যান্ড রাইজ অব ইস্টার্ন পপ কালচার। সবশেষ বইটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।তিনি পাকিস্তানের বৃহত্তম উর্দু পত্রিকা জং ও দি নিউজ পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লিখে থাকেন। তিনি ২০০৬ সালে লেবানন গিয়ে লেবাননে ইসরাইলি আক্রমণের খবর পরিবেশন করেন। এছাড়া ২০০৭ সালে ইরান ও ২০০৮ সালে কিউবা সফর করেন সাংবাদিক হিসেবে খবর পরিবেশন করার জন্য। তার লেখা নিউ স্টেটসম্যান, দ্য ডেইলি বিস্ট, দ্য গার্ডিয়ান ও ক্যারাভান ম্যাগাজিনেও প্রকাশিত হয়।
ফাতিমা তার ফুফু বেনজির ভুট্টো ও তার স্বামী আসিফ আলী জারদারির একজন কঠোর সমালোচক। তার অভিযোগ, বাবা মর্তুজা ভুট্টোর হত্যায় জড়িত ছিলেন তারা। ১৯৯৬ সালে বোন বেনজির ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে করাচিতে তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। গত বছর ৪০ বছর বয়সে গ্রাহাম বিরা নামে এক মার্কিন নাগরিককে বিয়ে করেন ফাতিমা। করাচিতে তার পারিবারিক বাড়িতে এই বিবাহ অনুষ্ঠান হয়। বিয়ের পর জিবরান নাম নেন গ্রাহাম।